হারিয়ে যাওয়া প্রিয় মানুষের
হতাশার
কথা থাকুক , আজ না হয় কেবল ভালোবাসার কথাই শোনাই সবাইকে, কিছু অপরিচিত
মানুষের থেকে অযাচিতভাবে পাওয়া অন্যরকম আবেগের স্মৃতি , যাদের সাথে হয়তো
আর কখনোই দেখা হবে না । বাইশটা বসন্ত পেছনে ফেলে আসা জীবনে কতো মানুষই তো
নিঃস্বার্থভাবে আমার সাদা - কালো সময়কে রাঙ্গিয়ে দিয়েছে একটু একটু করে ।
কিন্তু কার কথা বলব প্রথমে ?
সেই মাঝবয়েসী আংকেলটার কথা বলি ? যিনি প্রচন্ড এক বৃষ্টির দিনে পানি জমে সমুদ্র হয়ে যাওয়া কলেজের সামনের রাস্তাটা ধরে পা টিপেটিপে হাঁটার সময় গর্তে হুমড়ি খেয়ে পরার টেনে তুলেছিলেন নিজে ভিজে গিয়ে? তারপর পকেট থেকে রুমাল বের করে আমার ভিজে জবজবে হয়ে যাওয়া শরীরের যতটা পারা যায় মুছিয়ে দিয়ে বলেছিলন , " বাবা, আরেকটু সাবধানে চলতে হবে তো "। মোবাইল রাখার জন্যে তার দেয়া খামটা আজো রেখে দিয়েছি সযত্নে ।
কিংবা সেই শ্যামলা রঙ্গের অদ্ভুত সুন্দর চোখের মেয়েটা যে পাবলিক লাইব্রেরীর রিডিং রুমে পেছন থেকে চমকে দিয়ে হাসতে হাসতে প্রশ্ন করেছিলো বড় মানুষের ওমন বাচ্চাদের বই পড়ার কারণ কি? তারপর টুকটাক আরও কত প্রশ্ন! এতো আন্তরিক সাবলীলতায় মানুষ অপরিচিত কারো সাথে কথা বলে কিভাবে ভেবে পাচ্ছিলাম না । বাস্তব জীবনে মিশুকতার গুনবিহীন সবার থেকে আলাদা হয়ে একাএকা থাকা আমিও কিভাবে কিভাবে যেন হঠাৎ-ই বদলে গিয়ে বলে ফেললাম অনেক কথা । একটু পর যখন মানুষটা বিদায় নিয়ে চলে গেলো তখন আবিষ্কার করলাম আমি তার নামটাই জানি না । প্রচন্ড মন খারাপ করে রিডিং রুমের চেয়ারটাতে অনেকক্ষন একা বসে ছিলাম কেন সে দিন? সে জানেও না আজও শাহবাগের আশপাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় খুব মনে পরে তার কথা । মনে হয়, ইশশ্! কেন মানুষটার নাম জিজ্ঞেস করলাম না সেদিন?
ড্রাইভার, হেলপার শ্রেণীর মানুষরা বাজে প্রকৃতির হয় এমন ধারণা আমারও ছিলো সে দিন পর্যন্ত যে দিন অনেকটা রাস্তা যাওয়ার পর ভাড়া দিতে গিয়ে পকেটে হাত দেয়ার পর বুঝেছিলাম মানিব্যাগ হারিয়ে গেছে । সম্ভাব্য অপমানের ভয়ে প্রচন্ড অস্বস্তি নিয়ে বললাম, " বাস থামান । মানিব্যাগ হারিয়ে গেছে, আমি নেমে যাবো "। কিছুটা অবাক করে দিয়েই বাসের হেলপার বলল, " আরে বাই, নামবেন ক্যান? থাহেন, কোন সমস্যা নাই ।" অথচ আমার গন্তব্য খুব একটা কাছে ছিলো না ।
জীবনে প্রথম কোন সমবয়সী মেয়ের সাথে একটানা অনেকক্ষণ বসে থাকার ব্যাপারটা ঘটেছিলো ক্লাস এইটে । না থেকে উপায় ছিলো না, একদিনের মূল্যায়ন পরীক্ষার সিট পরেছিলো একসাথে । খাতায় নাম লেখার সময় আড়চোখে তাকিয়ে দেখলাম তার নাম সুমি । পরীক্ষার তিন ঘন্টার মধ্যে তিন - চারটা বাক্য ছাড়া আর কোন কথা হয়েছিলো বলে মনে পরে না । আর শেষ হওয়ার পর তো চলেই এলাম । তবুও সে কেন যেন কিছুদিন পরে আমার এক বন্ধুকে দিয়ে অনেকটা তার মতোই দেখতে একটা পুতুল উপহার পাঠিয়েছিলো । আর কখনো দেখা বা কথা কোনটাই হয় নি তার সাথে । কলেজে ভর্তি হবার পর খবর পেয়েছিলাম তার নাকি বিয়ে হয়ে গেছে । কোন মানে হয়?
পুতুল পুতুল ভাব ছিলো কিছুটা তিন বছরের শ্রাবনের মধ্যেও । বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠগুলোর দিকে তাকালেই তার কথা মনে পড়ে । অপরিচিত আমাকে আপন করে নিয়ে আঙ্গুল ধরে তার গুটগুট করে হাঁটা আর প্রায় জোর করে কোলে উঠে অনেকক্ষণ ঘুরে বেড়ানোর সময়টাকে মিস করি ভীষন! এতো ক্লাস করতে যাই, তবু শ্রাবনের সাথেও আর কখনো দেখা হলো না ।
আরো অনেকের কথা মনে পড়ছে, নাই-বা লিখলাম । অনেক তো লিখে ফেলেছি এরই মধ্যে । আসলে আমার কাজই হলো স্মৃতি জমানো । তাই বলতে শুরু করলে শেষ হবে না । জানি পরিচিত থেকেও একদিন হঠাৎ আগন্তুক হয়ে ওঠা অনেকের মতো তাদের কারোরই হয়তো আমার কথা মনে নেই, কিন্তু আমার সবার কথাই মনে আছে, খুব তীব্রভাবে । আমার ভালোবাসা দিবসের শুভেচ্ছা বিশেষভাবে তাদের জন্যে ।
শুভ ভালোবাসা দিবস আমার হারিয়ে যাওয়া প্রিয় মানুষেরা :)
Comments
Post a Comment