আষাঢ়ে স্মৃতি

এক
 বাইরে তুমুল বৃষ্টি হচ্ছে। প্রকৃতি যেন নূপুর পায়ে ঝুমঝুম আওয়াজ তুলছে। লতিফা বানু আনমনে হাসছেন এই ভেবে যে তার জীবনের অতি দুখের কিংবা সুখের দিনে আকাশ তার অশ্রু ঝরাবেই।
আজ আষাঢ়ের প্রথম দিন।লতিফা বানুর জীবন এর এক আনন্দের দিন ।আজ তার একমাত্র নাতনি মিম এর জন্মদিন।বছরের এই দিন টির জন্য তিনি অধিক আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করেন।লতিফা বানুর খুব ইচ্ছে তার নাতনির জন্মদিন খুব জাকজমকপূর্ণ ভাবে পালন করতে –সারা বাড়ীতে আলোক সজ্জা ,বিরাট হইচই,দুর থেকে মনে হবে বিয়ে বাড়ি।কিন্তু তার সে আশা কোনোদিন পুরন হয় নি।কারন লতিফা বানু র ছেলে মিম এর বাবা রশিদ উদ্দিন খুব ধার্মিক মানুষ।ইসলাম ধর্মে কেক কেটে নাচ গান করে জন্মদিন পালন করা অতি গর্হিত কাজ ।রশিদ উদ্দিন এ দিনে বাড়িতে দোয়া মাহফিল এর আয়োজন করেন।ফকির মিসকিন খাওয়ান । ছেলে টা তার মত হয় নি,হয়েছে তার বাবার মত ।লতিফা বানুর গান বাজনার প্রতি বিশেষ আগ্রহ ছিল ।
ঘড়িতে ১২ঃ৩০ বাজে। কিছুক্ষণের মধ্যেই না্তনি আসবে আশীর্বাদ নিতে।নাতনির মুখ দেখলে আরো কিছুদিন বাচতে ইচ্ছা করে । কিন্তু বয়স তা শুনবে কেন? তিনি জানেন তার সময় শেষ হয়ে এসেছে।লতিফা বানু চোখ বন্ধ করলেন। ঘড়ির শব্দ শোনা যাচ্ছে টিক টিক টিক ।



দুই
লতিফা বানু তার নাতনির গায়ের গন্ধ পাচ্ছেন। তিনি চোখ বন্ধ অবস্থায় বললেন,
-লতিফা বানুর বয়স কত হল?
-লতিফা বানুর ১৫ বছর হল ।দাদি তুমি কিভাবে টের পেয়ে যাও যে আমি এসেছি । Its amazing
মিম দাদি কে সালাম করল ।
-খাটের উপর উঠে আয় ।
-দাদি গল্প বল(মিম এর বায়না) রাক্ষস খোক্ষস এর গল্প না,আমি এখন বড় হয়ে গেছি। ১৫ বছরের বুড়ি বুঝলে?(মিম এর দুষ্টুমাখা হাসি)
লতিফা বানু শব্দ করে হাসলেন ।সেই ১৫ বছর। ছানি পরা চোখে তার চারপাশ ঝাপসা ঠিকই কিন্তু ১৫ বছর এর সেই স্মৃতি আজও চির অম্লান,স্বচ্ছ।
লতিফা বানু সেই দিন গুলোর কথা বলা শুরু করলেন----
আমার বয়স তখন ১৫ বছর ।এই বয়সের মেয়ে দের মধ্যে এক ধরনের মুগ্ধতা কাজ করে। খুব অল্প তেই তারা মুগ্ধ হয়। আমিও মুগ্ধ হতাম বৃষ্টির শব্দ শুনে,বৃষ্টির ফোঁটার আঘাতে লজ্জাবতী গাছ এর লজ্জায় নুয়ে পরা দেখে মুগ্ধ হতাম,আর মুগ্ধ হতাম এক জনের গায়কী তে। কি অদ্ভুত মায়াবী সুর!যে সুর কান এ বাজলে বুক টা হু হু করে উঠে।
-কার কথা বলছ দাদী?
-সঞ্জয় দা!আমাদের পাড়ার বাউল ।

তিন
লতিফা বানুর চোখে ভেসে উঠছে উঠুনে আঁকা এক্কা দক্কা খেলাঘর,সখিদের অট্ট হাসির শব্দ।
-কিরে লতিফা আইজ পালা দেখতে যাইবি না?সঞ্জয় দা নতুন গান বানছে ।আইজি প্রত্থম শুনাইব।
-হু যামু ত ।আনন্দে ঝলমল করছে লতিফার মুখ।সে জানে শঞ্জয় দা মঞ্চে উঠার আগে তাকে একবার শুনাবে গান গুলো।কেমন হয়েছে জিজ্ঞেস করবে ।
লতিফা এক দৌড়ে ছুটে গেল গ্রামের শেষ মাথায়। যেখানে জীর্ণ কুটিরে থাকে আপন জন হারা সদ্য যৌবনে পা দেওয়া এক টগবগে তরুন।যার গলায় আছে অসাধারন মায়াবি সুর। দোতারা যার একমাত্র আপনজন ।
-কি রে লতিফা?এই ভর দুপুর এ একা একা আমার এখানে আইতে তোকে মানা করছি না?গায়ের লোকজন কি কইব?
-তুমি মানা করার কে? লতিফা নিজের কথাত চলে। (ঠোঁট উল্টিয়ে জবাব দেয় লতিফা)
-ওরে বাপ রে! মাইয়ার ভাবখান দেখ।যাই হক,গান গুলা বানছি,কেমন হইছে ক তো । আমি দোতারায় টান দিলাম ।
দোতারাই সুর উঠছে!লতিফা যেন অন্য কোন ভুবনে হারিয়ে যাচ্ছে ।কি মধুর সুর!এ সুর শুনার জন্য অনন্ত কাল অপেক্ষা করা যায় ।লতিফার চোখ ভিজে উঠছে। এই চোখের পানি তাকে দেখানো যাবে না ।কখনও কখনও চোখের পানি লুকিয়ে রাখতে হয়।পৃথিবীর সবচেয়ে সহজ ভাষা হল চোখের ভাষা।যে ভাষায় বর্ণ নাই,শব্দ নাই,আছে শুধু নীরবতা।


-লতিফা বল দেখি কেমন হইছে?
-অতি জঘন্য হইছে।ধুর এই গান শুনার লাইগা আইছি নাকি এত দুর!যাই গা (লতিফা অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে এক টানে কথা গুলো বলল আর দৌড়ে পালাল )
সারা পথ লতিফা কাঁদল ।কেন সে বলল গান গুলো ভাল হয় নি!কেন তার মনে আঘাত দিল।কান্না লুকাতে চেয়েছিল এই যা ।তাই বলে তার মনে আঘাত দিয়ে নয়। কেন তার কাছে গেলে সব কিছু এলোমেলো হয়ে যায়? কেন এত লুকুচুরি খেলি আমি! খানিক পরেই অভিমান এ গলা ধরে এল আবার।
আমাকে বুঝার চেষ্টাও তো করে নি বাউল।কারনে অকারনে তাকে দু দণ্ড দেখার জন্য ছুটে যাই।বাউল ঠিক ই বুঝে ,না বুঝার ভান করে। (এক মনে বির বির করে লতিফা)
মন নিয়া গান বানে,
মনের খবর নাহি জানে।
থাকি চেয়ে তাহার পানে,
বলবে এসে গানে গানে,
তরে ছাড়া মন নাহি মানে।
-হি হি হি(লতিফা এক মনে ফিক করে হেসে ফেলে) হঠাৎ তার মনে পরে উঠোনে এক্কা দক্কা খেলা এখনও চলছে মনে হয়।দৌড়ে ছুটল বাড়ির দিকে।


চার
কিশোরী লতিফার মায়াময় ভালবাসার লুকুচুরি ভালই চলছিল।হাসি-কান্না অভিমানমাখা ভালবাসার সাম্রাজ্য তার। তার এই ভালবাসার সুর গান হয়ে কখনই পৌঁছত না তার ভালবাসার মানুষের কাছে।
-তারপর?তারপর কি হল দাদি?
লতিফা একটু সচকি্ত হল।তিনি ভুলেই গিয়েছিলেন তিনি এখন ৮০ বছরের বৃদ্ধা। দাদি নাতনির গল্প চলছে এখানে।তার চোখের সামনে শুধু ভাসছিল লাল-নিল কাগজ দিয়ে সাজানো বাড়ি। বেনারশি শাড়ি,লাল চুড়ি,গয়না সাজানো তার চারপাশে।
-পুতুল খেলার ছলে যে দিনটির স্বপ্ন বোনে মেয়েরা সে দিনটি এল আমার জীবনে।তোর দাদুর সাথে আমার বিয়ে হয়ে গেল। সেদিনকার সেই ছোট্ট লতিফার নিষ্পাপ ভালবাসার কথা কেও জানল না। এই পৃথিবী কে জানানোর সাহস লতিফার ছিল না।
-দাদি so sad! আমার খুব কান্না পাচ্ছে।
মিম মুখ গুজে কাঁদছে ।লতিফা তাকে বাধা দেয় নি। কাদুক!তিনি একাই কেঁদেছেন বছরের পর বছর।কিছু কিছু বেদনা মানুষ কে সারা জীবন বয়ে বেড়াতে হয়।একান্ত নিজের কিছু কষ্ট। আজ জীবনের শেষ সময় এ তার না বলা ভালবাসার গল্প দাদি-নাতনির রুপকথার গল্পে ধরা দিয়েছে।এতটুকু সান্ত্বনা নিয়ে ত পৃথিবী ছেড়ে যেতে পারব যে কেউ  একজন আমার ভালবাসার গল্প শুনে কেঁদেছে।
-(দাদি মিম এর মাথায় হাত বুলাচ্ছে আর ভাবছেন )আচ্ছাসঞ্জয় দা কি এখনও বেঁচে আছে? যদি কোনোদিন সে আমার সামনে আসতো তবে কিশোরী লতিফার মত অভিমানি গলায় তাকে বলতাম ----
তুমি কি কোন এক মুহূর্তও আমাকে ভালবাস নি?একটি বার এর জন্য ও?নাকি ভয় পেয়েছিলে?এই সমাজ কে,ধর্মের ভিন্নতা কে নাকি শুধু ভালবেসেছিলে তোমার বৈরাগী হওয়ার সুপ্ত বাসনা কে।
মনে পরে সেই দিন এর কথা। প্রচণ্ড বৃষ্টি হচ্ছে ।আমি ছুটে চলছি তুমার মাটির ঘরের দিকে।পরনে হলুদ শাড়ি। সেই চেনা দোতারা আর ঝুলা ব্যাগটা তোমার কাঁধে।গানের সন্ধানে অজানাই যাত্রার জন্য প্রস্তুত তুমি ততক্ষনে ।
-তোকে অনেক সুন্দর লাগসেরে লতিফা।হইলদা রাজকন্যা ভাল থাকিস!
আমার বুকের ভিতর তা ডুকরে কেদে উঠল। চীৎকার করে বলতে ইচ্ছে করল—যেও না বাউল,সারা জীবন থাকো আমার পাশে।
 কিন্তু আমার কথা তুমার কাছে পৌঁছোবার আগেই ঝড়ের বেগ তা নিয়ে যাচ্ছে বহুদূর। চোখে জল এল। আমি চোখের ভাষাই তুমাকে বলার চেষ্টা করছি।কিন্তু বর্ষার অবিরাম বৃষ্টি আর আমার চোখের জলধারা মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল। আষাঢ়ে বৃষ্টির ফোঁটা হয়ে পড়ল তোমার উঠোনের সেই চেনা কদম তলায় ।

https://www.facebook.com/karimmufte?ref=tn_tnmn

Comments

Popular posts from this blog

Learning to Pray

Arduino and MQ 2 gas sensor