অথৈ অথবা আমি.......


(১)
চুরি জিনিসটা অপরাধের স্কেলে উপরের দিকে থাকলে ও এটা স্বীকার করতে নিশ্চয় কেউ দ্বিধান্বিত হবে না যে কিছু কিছু চুরি উঁচু পর্যায়ের আর্ট হিসেবে বিবেচিত হয়। আমার এক চাচা ছিলেন,যিনি চুরি জিনিসটা কে মহৎ  শিল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য মাঠে নেমেছিলেন। তিনি চোখের সামনে থেকে যে কোন জিনিস হাপিস করে ফেলতেন। এমন না যে তিনি প্রফেশনাল চোর ছিলেন। তিনি যে কোন জিনিস হাপিস করার পর আবার ফিরিয়ে দিতেন। মানুষের চোখের সামনে থেকে যে কোন কিছু হাপিস করতে পারলেই তার দু'চোখ আনন্দে চিকচিক করে উঠতো। পুনরায় যখন চুরি করা জিনিসটা যথাযথ মালিককে ফিরিয়ে দিতেন,তখন গম্ভীর স্বরে বলতেন,"চুরি জিনিসটাকে খারাপ চোখে দেখবেন না। প্রোপার কৌশলে চুরি করতে পারলে সেটি আর চুরি থাকে না,সেটি হয়ে যায় আর্ট!"
চাচা চুরি বিষয়টাকে আর্টের পর্যায়ে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন কিন্তু পারেন নি। কারন তার বেরসিক আত্মীয় স্বজন চুরি যে একটি আর্ট এ বিষয়টি বোঝেনি। এমন একটা সময় এলো যে তার নামের পূর্বে যুক্ত হয়ে গেলো "চোরা" আর বন্ধ হয়ে গেলো সব আত্মীয় স্বজনের বাসার দরজা!
আমি আমার ঐ চাচার মত অত বড় আর্টিস্ট না হলে ও,নিজেকে ছোট খাটো আর্টিস্ট ভাবতে পছন্দ করি। এই মুহুর্তে আমি আমার সমস্ত প্রতিভা ঢেলে দিচ্ছি ক্যরামের গুটির পেছনে। ক্যরামে চুরি করার ক্ষেত্রে কিছু নিয়ম কানুন ফলো করতে হয়। সিঙ্গেল খেলায় নিজের গুটি গুলো কে আগে নিজের দিকে নিয়ে আসতে হয়। পরবর্তী ধাপে বিপক্ষের সাথে যে কোন একটা বিষয় নিয়ে আলাপ জুড়ে দিতে হয়। অপেক্ষা করতে হয় বিপক্ষের অসতর্কতার। এরপর সুযোগমতো হাতের নাগালে পাওয়া গুটি স্ট্রাইক ঘোরার সাথে সাথে পর্যায়ক্রমে পকেটে ভরে ফেলতে হয়। খুবই সুন্দর কৌশল। এই কৌশল অনুসরন করে পূর্বে ও বিপক্ষকে পানি খাইয়ে ছেড়েছি। তবে এই মুহুর্তে আমার সব কৌশলই মাঠে মারা যাচ্ছে। কথার ফাঁকে অথৈ কে আটকে রেখে গুটি পকেটে ভরতে গিয়ে কয়েক বার হাতে নাতে ধরা পড়েছি। ধরা পড়া সমস্যা না,সমস্যা অন্য জায়গায়। প্রতিবারই ধরা পড়ার পর অথৈ আমার হাতে মার্কার তুলে দিচ্ছে। আর আমাকে বোর্ডের পাশের কাঠে লিখতে হচ্ছে,"আমি চোর!"
এই পর্যন্ত পাঁচবার লেখা হয়েছে,"আমি চোর!"
এই কাজটা করতে অবশ্য আমার খুব একটা খারাপ লাগছে না। ষষ্ঠবারের মতো যখন আনন্দের সাথে "আমি চোর" লিখছি,তখন অথৈ বলে উঠলো,
- ভাইয়া! তুই একটু চিন্তা করে দেখ,তুই যেখানেই যাচ্ছিস সেখানেই মানুষ তোর দিকে আঙ্গুল তাক করে বলছে,"তুই চোর,তুই চোর!" চিন্তা করতেই তো আনন্দে আমি দিশেহারা হয়ে যাচ্ছি!
আমি গলা খাকারি দিয়ে কন্ঠস্বর গম্ভীর করে বললাম,
- "আনন্দিত হওয়ার কিছু নেই। ইতিহাস বলে চোরদের ভাই বোন দের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। পাবলিক চোরের দিকে যতবার আঙ্গুল তোলে,তার থেকে ও বেশীবার আঙ্গুল তোলে তার আত্মীয় স্বজনের দিকে। কোন দিন যদি আমি প্রতিষ্ঠিত চোর হয়েই যায়,তাহলে আমার বোন হিসেবে তোর ভবিষ্যৎ অন্ধকার! হয় তো তোর কপালে ভালো বরই জুটবে না।"
অথৈ কিছু একটা বলতে চাচ্ছিলো। আমি ওকে সে সুযোগ না দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে হাঁটা শুরু করলাম। আর্ট কি জিনিস তা বোঝার ক্ষমতা পিচ্চি পাচ্চাদের থাকে না।


(২)
বাসায় আসার পর আমাকে টিউটর হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে হয়। অনিচ্ছাকৃত দায়িত্ব পালন। স্টুডেন্ট যদি টিচারের চেয়ে দু'তিন লাইন বেশী বোঝে,তাহলে টিচার হয়ে মান সম্মান নিয়ে টানাটানি তে পড়ার কোন মানে হয় না। অথৈ অবশ্য মহানন্দে বই খাতা নিয়ে হাজির হয়ে যায়। এরপর দুনিয়ার যাবতীয় বিষয় নিয়ে আলাপ করা শুরু করে। পাশের বাসার সাত মাসের পিচ্চি রাত কয়টা থেকে কয়টা পর্যন্ত গলা সাধে,আশেপাশে নতুন করা এসেছে,মোড়ের দোকানে নতুন কোন আইস্ক্রীম এসেছে,বাবা কোন দিন এক পায়ে জুতা পরে অফিসে রওনা হয়েছিলেন,মা রান্না করতে গিয়ে কয়বার আমার কথা বলেছে!
আমি মাথা নাড়ি অথবা "হু,হা" করি।
আজ যখন বই খাতা নিয়ে আমার রুমে এসে অথৈ হাজির হলো,স্বাভাবিক ভাবেই ধরে নিয়েছিলাম রুটিনের ব্যতিক্রম হবে না। কিন্তু অথৈ বললো,
- "ভাইয়া! একটা সুখবর আছে। আমি না পুডিং তৈরী করতে পারি!"
আমি অবাক হয়ে বললাম,
- "বাবা-মা এখনো পাত্র খোঁজা শুরু করে নি?"
- "ভেবেছিলাম তোকে খাওয়াবো,তৈরী করে ও রেখেছিলাম। কিন্তু এখন সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করলাম।"
আমি অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে আমতা আমতা করে বললাম,
- "তোর পুডিং ভালো হয় না। চিনির পরিমান খুবই কম থাকে। মুখে দিলেই কাঁচা ডিমের গন্ধ বের হয়।"
- "তুই......."
কথা শেষ না করেই অথৈ ছুটে বের হয়ে গেলো। কিছুক্ষনের মাঝেই ফিরে এসে বললো,
- "শেষ করে ফেলেছিস? আমি সারাটা বিকেল কষ্ট করে তৈরী করলাম,আর তুই চুরি করে খেয়ে ফেললি?"
- "তৈরী করেছিস কার জন্য?"
- "তোর জন্য!"
- "তাহলে সমস্য কোথায়! তুই নিজের হাতে তৈরী করেছিস আমার জন্য আর আমি নিজ হাতে খেয়ে ফেলেছি। এর মাঝে তো কোন ঝামেলা দেখি না!"
অথৈ কিছু একটা বলতে যেয়ে থেমে যায়। ভীষন রেগেছে বোধহয়,কি বলবে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। আমি কিছুটা উপদেশের সুরে বলি,
- "পরবর্তীতে চিনির পরিমান একটু বাড়িয়ে দিস। ডিমের কাঁচা গন্ধটা যেনো না আসে সে দিকে ও খেয়াল রাখিস। আর......."
আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই অথৈ রুম থেকে বের হয়ে যায়। আমি মহানন্দে বালিশে মাথা রেখে বিছানায় এলিয়ে পড়ি। অনেক দিন সন্ধ্যায় ঘুমানো হয় না। চোখ বন্ধ করার আগে অথৈর কন্ঠ শুনতে পেলাম,
- "মা! ভাইয়া যাবে কবে?"


(৩)
আজ দিনটা শুরুই হয়েছে খারাপ ভাবে। ঘুম ভাঙ্গার সাথে সাথেই নিয়াজের ফোন পেলাম। মাথা তখনো ভালো ভাবে কাজ করা শুরু করে নি। তার ভেতর নিয়াজের ঝড়ো গতিতে বলে যাওয়া কথা গুলো শুনে যা বুঝলাম তা হলো,সেমিস্টার ফাইনালের ডেট ফিক্সড হয়েছে। তল্পিতল্পা সহ ভার্সিটির উদ্দেশ্যে রওনা দিতে হবে।
পরিচিত শহরটা ছাড়তে ইচ্ছে করে না। পরিচিত মুখ গুলো চোখের আড়াল করতে ইচ্ছে করে না।
"দূরত্ব যতই হোক,কাছে থাকুন" শ্লোগানের এই যুগে দূরে থাকার পর ও,মুঠোফোনের সুবাদে আপন মানুষ গুলোর কন্ঠ শুনতে পাওয়া যায়। ভিডিও চ্যটিংয়ের এ যুগে চোখের সামনে মানুষ গুলো কে দেখা যায়। তারপরো কোথায় যেনো একটা "কিন্তু" থেকে যায়। কোথায় যেনো একটা শূন্যতা থেকে যায়।
দরজায় নক্ করার শব্দ হচ্ছে। বিছানা ছাড়তে ইচ্ছে করছে না। যার ইচ্ছে নক্ করুক।
- "ভাইয়া,উঠবি না?"
আমি চুপ করে থাকি। কথা বলতে ইচ্ছে করছে না।
- "আমাকে একটু কোচিংয়ে দিয়ে আসতে পারবি? ভাইয়া উঠেছিস? এই ভাইয়া!"
- "মা কে সাথে নিয়ে যা। আমি আজ বের হবো না।"

জানালা গলে সূর্যের আলো আসছে। তপ্ত আলো। তবু বিছানা ছাড়তে ইচ্ছে করছে না। মা এবং অথৈ চলে গেছে। বাসাটা নিশ্চুপ হয়ে আছে। কেমন এক শূন্যতা এসে ভর করেছে বাসার দেয়ালে দেয়ালে.......

ডাইনিং টেবিলের উপর পেপার ওয়েট দিয়ে একটি কাগজ চাপা দেওয়া। পেপার ওয়েট সরিয়ে কাগজের ভাঁজ খুলতেই চোখে পড়ে অথৈর হাতের লেখা,
"ডিম ভাঁজি করে রেখে গেলাম। খেয়ে দেখিস তো ভাইয়া,কাঁচা ডিমের গন্ধ আসে কি না!"
আমি অবাক হয়ে কাগজটার দিকে তাকিয়ে থাকি। বুকের ভেতর একটা হাহাকার অনুভব করি আমি। অনেক দিন এই পাগলিটার পাগলামি দেখতে পারবো না। অনেক দিন পাগলিটা কে ক্ষেপাতে পারবো না। অনেক দিন হয় তো রিকশায় বসে ওর বকবকানি শুনে বিরক্ত হয়ে ওঠা হবে না।
কাগজটা নিয়ে নিজের রুমে চলে আসি আমি। মার্কার দিয়ে উল্টো পাশে বড় বড় করে লিখি,"পাগলি!"
অথৈর টেবিলে কাগজটা রেখে বেরিয়ে পড়ি আমি। বাসের টিকিট কাটতে হবে। খুব সকালে ছেড়ে যাওয়া কোন বাসের টিকিট.......


(৪)
সূর্যের ঘুম এখনো ভালো ভাবে ভাঙ্গেনি। অলস ভাবে আলো ছড়াচ্ছে। তেতে উঠতে খুব একটা সময় নেবে না। বাস স্ট্যন্ডে পৌছে যেতে পারবো সূর্য উশৃংখল হওয়ার আগেই। বাবা আসতে চেয়েছিলেন বাস স্ট্যান্ড পর্যন্ত। নিষেধ করেছি।
ঘুম জড়ানো চোখে আড়মোড়া ভাঙা শহর দেখতে দেখতে এগোচ্ছি। রিকশাওয়ালা মামা ফাঁকা রাস্তা পেয়ে রিকশা না চালিয়ে নভোযান ছুটাচ্ছেন। আচ্ছা,মামা কে কি বলবো,মামা একটু আস্তে চালান। চেনা শহরটা কে শেষবারের মত ভাল ভাবে দেখি। দীর্ঘ দিনের জন্য এই শহরের মায়া কাটিয়ে যাচ্ছি আমি। একটু আস্তে চালাবেন মামা?
ফোন বাজছে। ইচ্ছে করছে না রিসিভ করতে। যার খুশী সে ফোন করুক,যার খুশী আমায় খুঁজুক,আমি মায়া ভরা এই শহর দেখি।
অনিচ্ছা স্বত্ত্বে ও ফোন বের করি পকেট থেকে। স্ক্রীনের দিকে না তাকিয়েই রিসিভ করে কানে লাগিয়ে বসে থাকি।
-"হ্যলো! ভাইয়া!"
আমার বুকের মাঝে কেমন অচেনা এক শূন্যতা এসে ভর করে! যে শূন্যতার মাঝে শুধু তলিয়ে যেতে হয়,গভীর থেকে আরো গভীরে।
-"ভাইয়া! শুনছিস?"
-"হুম!"
-"আমাকে না বলেই চলে গেলি ভাইয়া?"
আমি শক্ত হয়ে বসে থাকি। ওপাশে স্তব্ধতা,এপাশে ও। আচ্ছা,সৃষ্টিকর্তা এতো মায়া দিয়ে সম্পর্ক গুলো তৈরী করেন কেন? মায়ার পরিমান একটু কমিয়ে দিলে কি হতো?
ওপাশ থেকে মৃদু ফোঁপানির শব্দ ভেসে আসে। আমি ফোনটা শক্ত করে ধরে রাখি। আরেকটু শক্ত করে চেপে ধরি কানের সাথে.......

আচ্ছা,বাসস্ট্যন্ড আর কত দূরে? কত সময় লাগবে আর এই শহরটা ছাড়তে আমার?

Comments

Popular posts from this blog

Arduino and MQ 2 gas sensor

Arduino Sound Sensor Module / Sound Sensor with arduino Code