মা

সক্রেটিস এই বিশ্বজগতের নিগূঢ় রহস্য নিয়ে আলোচনার চেয়ে জীবন ও সমাজের বাস্তব বিষয়াদি নিয়ে আলোচনায়ই তিনি ছিলেন বেশি আগ্রহী। যেমন, সৃষ্টির সেরা জীব হিসাবে মানুষের আচরণ কেমন হওয়া উচিত? মানুষের মহত্ত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব কিসে নিহিত? - এ জাতীয় জীবনধর্মী প্রশ্নের উত্তরানুসন্ধানই ছিল তার চিন্তার অগ্রাধিকার। ন্যায় (justice) ও শুভ (goodness) কী, তা জানতে তিনি আগ্রহী ছিলেন ন্যায়নিষ্ঠ ও শুভজীবন-যাপনের জন্য। তার দৃঢ় বিশ্বাস ন্যায় ও শুভ কী, তা না জেনে কেউ ন্যায়বান ও কল্যাণনিষ্ঠ হতে পারে না। তার মানে, জ্ঞান ও প্রজ্ঞাই মানুষের সদাচরণ ভিত্তি। আরো এক ধাপ এগিয়ে সক্রেটিস বলেন, আচরণের জন্য জ্ঞানবুদ্ধি যে শুধু অপরিহার্য তাই নয়, সত্যিকারের জ্ঞানী ব্যক্তি কখনো অন্যায় করতেই পারেন না। আবেগ-উচ্ছ্বাস নয়, প্রজ্ঞাই (reason) ছিল তার চিন্তা ও কর্মের চালিকাশক্তি। প্রজ্ঞার আলোকে তিনি যে মূল্যবোধ দর্শন করেছেন, তাকেই তিনি নিষ্ঠার সাথে অনুশীলন করেছেন। ন্যায় ও কল্যাণের ধারণা থাকা সত্ত্বেও মানুষ কী করে অন্যায়-অকল্যাণে প্রবৃত্ত হতে পারে, এ ছিল তার চিন্তার বাইরে।

সক্রেটিস মনে-প্রাণে বিশ্বাস করতেন যে, নিজ আত্মার যত্ন নেয়া, আত্মাকে সৎ ও শুভ লক্ষ্যে পরিচালিত করা মানুষের অভিষ্ট। আত্মা বলতে আমরা যা বুঝি, ইউরোপে সর্বপ্রথম এ ধারণা প্রবর্তন করেছিলেন সক্রেটিস। তিনিই সর্বপ্রথম আত্মাকে কল্পনা করেছিলেন একটি বুদ্ধিসঞ্জাত নৈতিক শক্তি হিসাবে- এমন শক্তি যা ব্যক্তির ভালো বা মন্দ আচরণের জন্য দায়ী। আত্মার অমরত্ব প্রসঙ্গে সক্রেটিসের মত সম্বন্ধে বিস্তারিত কিছু জানা না গেলেও তিনি যে আত্মার অমরত্বে বিশ্বাসী ছিলেন, তা তার একটি প্রসিদ্ধ উক্তি থেকে অনুমান করা যায়। অন্যায় অপবাদে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত সক্রেটিস হেমলক লতার বিষপানের পর মৃত্যুর পূর্বমুহূর্তে শোকাভিভূত আত্মীয়-পরিজনদের লক্ষ্য করে বলেছিলেন, "তোমরা দুঃখ করো না। কারণ, এই মৃত্যু কেবল আমার দেহটাকেই বিনাশ করবে, আত্মাকে নয়।"

সক্রেটিস গভীরভাবে বিশ্বাস করতেন শিক্ষাই মানুষের শ্রেষ্ঠ সম্পদ, শিক্ষার মধ্যেই মানুষের অন্তরে জ্ঞানের পূর্ণ জ্যোতি উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। জ্ঞানের মধ্যদিয়েই মানুষ একমাত্র সত্যকে চিনতে পারে। যখন তার কাছে সত্যের স্বরূপ উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে সে আর কোনো পাপ করে না। অজ্ঞানতা থেকেই সব পাপের জন্ম। তিনি চাইতেন মানুষের মনের অজ্ঞানতাকে দূর করে তার মধ্যে বিচার-বুদ্ধিবোধকে জাগ্রত করতে। তিনি যুবকদের সুপথে পরিচালিত হওয়ার শিক্ষা দিতেন। সক্রেটিস তীব্রভাবে বিশ্বাস করতেন যে দুনিয়া সম্পর্কে জানার আগে মানুষকে নিজেকে জানতে হবে; এর একমাত্র মাধ্যম হলো যৌক্তিক চিন্তাভাবনা। তাই তিনি জোরের সাথে বলেছেন জগতকে জানতে হলে আগে নিজেকে জানতে হবে, এই প্রেক্ষাপটেই সক্রেটিস বলেছিলেন (know thyself)।

সক্রেটিসকে যদি হেমলক পানে মারা না হত তাহলে জগৎ হয়তো আরো অনেক মহৎ জ্ঞান পেতে পারত। কিন্তু তার মৃত্যুর মধ্যদিয়ে তার নশ্বর দেহের শেষ হলেও চিন্তার শেষ আজও হয়নি। তার প্রিয় শিষ্য প্লেটো এবং প্লোটোর শিষ্য অ্যারিস্টটলের মধ্যদিয়ে সেই চিন্তার এক নতুন জগৎ সৃষ্টি হলো, যা মানুষকে উত্তেজিত করছে আজকের পৃথিবীতে।

Comments

Popular posts from this blog

Learning to Pray

Arduino and MQ 2 gas sensor